অনলাইন ডেস্ক : ১৮ কার্তিক ১৩২৫ সিলেটে যাবার পথে করিমগঞ্জ রেল জংশনে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে যে মানপত্র প্রদান করা হয়েছিল তা পাঠের পর কবি প্রতুত্তরে সংক্ষিপ্ত ভাষণে বলেছিলেন,“পাশ্চাত্য হইতে কোন গৌরব যদি আমি ভারতবর্ষে বহন করিয়া আনিয়া থাকি সেটা আমার একার নহে সেটা আমার দেশের, দেশের গৌরব, জাতির গৌরব, প্রত্যেক ভারতবাসীর গৌরব।” এই গৌরবে আমাদের গৌরবান্বিত করেছিল রবীন্দ্রনাথের ‘গীতাঞ্জলি’। তবে বাংলা ‘গীতাঞ্জলি’ নয়, ইংরেজি ‘গীতাঞ্জলি’ —‘সং অফারিংস’-এর জন্য নোবেল পান রবীন্দ্রনাথ ১৯১৩-এ। আর ২০১৩ নোবেল প্রাপ্তির শতবর্ষ।
জগদীশচন্দ্রের মতে রবীন্দ্রনাথের সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠিত হতে পারে তার গল্পে। বন্ধুত্বের যথাযথ পরিচয় তিনি দেন। রবীন্দ্রনাথের ছয়টি গল্প অনুবাদ করে ইংরেজি কাগজে ছাপতে উদ্যত হন। রবীন্দ্রনাথ নিজে তখন ইংরেজি অনুবাদ নিয়ে যথেষ্ট সন্দিগ্ধ ছিলেন।জগদীশচন্দ্রের অনূদিত ছয়টি গল্প ইংল্যা-ের তৎকালীন প্রতিষ্ঠিত পত্রিকা ‘হারপার্স ম্যাগাজিন’ প্রত্যাখ্যান করে। ১৯০৯ সালে বিলেতে পাঠরত রবি দত্ত রবীন্দ্রনাথের এগারােটি গান ও কবিতার অনুবাদ তার ‘ইকোস ফ্রম ইস্ট অ্যা- ওয়েস্ট’এ সংকলিত করেন।এই ঘটনাগুলো থেকে আমরা অনুমান করে নিতে পারি, রবীন্দ্রনাথ বুঝতে পেরেছিলেন যে বিশ্বসাহিত্যে কবি হিসেবে স্থান পেতে গেলে তার ভাষা হতে হবে ইংরেজি। তিনি এও বুঝেছিলেন যে তার বাংলা ভাষার পূর্ণাঙ্গ রূপ ও মাধুর্য ইংরেজি অনুবাদে স্থানান্তর করা সম্ভব নয়। অতএব, বাংলা ভাষার বা তার কবিতার নিপুণ কলাকৌশল ও শৈলী নয়, অনুবাদে তিনি দিতে পারবেন তার কবিতার ভাব ও ভাবনা। অতএব, তিনি বেছে নেন গদ্য-অনুবাদের পথ।
বিখ্যাত ব্রিটিশ শিল্পী উইলিয়াম রথেনস্টাইন (১৮৭২-১৯৪৫) ভারতে এসেছিলেন ১৯১০-এ, জোড়াসাঁকোর বাড়িতে তার সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের পরিচয়ও হয়েছিল। তিনি মূলত চিত্রশিল্পী, প্রাচীন ভারতের শিল্প সম্বন্ধে তাঁর গভীর অনুসন্ধিৎসা ছিল।অজিতকুমার চক্রবর্তীর করা কিছু কবিতার ইংরেজি অনুবাদ তার হাতে এল, তা পড়ে তিনি আরও বেশি করে মুগ্ধ হলেন, গভীর বিস্ময়ও জাগল তার। এত বড় একজন অধ্যাত্মচেতনার কবি ইউরোপের কাছে অজ্ঞাত পড়ে থাকবেন? তিনি ল-নে ব্রাহ্ম নেতা প্রমথলাল সেন আর ব্রজেন্দ্রনাথ শীলকে অনুরোধ জানালেন রবীন্দ্রনাথকে যেন অবশ্যই লন্ডনে আসতে লিখে দেন তারা। এলে তাকে তিনি সানন্দে অভ্যর্থনা করবেন, আতিথ্য দেবেন। একদিন তার কাছে সেই আনন্দ-সন্দেশ পোঁছাল যে রবীন্দ্রনাথ লন্ডনে আসছেন। নিশ্চয় তার কবিতার তাগাদাও রবীন্দ্রনাথের কাছে পৌঁছেছিল।উইলিয়াম রথেনস্টাইনের সঙ্গে দেখা হতেই রবীন্দ্রনাথ তাঁর হাতে অনুবাদের ছোট খাতাটি তুলে দিলেন। পড়ে রথেনস্টাইন আত, পড়ে সমগ্র পৃথিবী আপুত হবে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘গীতাঞ্জলি’ -র ইংরেজি অনুবাদ ইংল্যান্ডে বুদ্ধিজীবীদের কাছে প্রথম পৌঁছায় এই রথেনস্টাইনের মাধ্যমে। তাদের বীণার ঝঙ্কারে ‘গীতাঞ্জলি’র সুর ও স্বর সুরভিত হয় দিক-দিগন্তে, যাদের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা ও আন্তরিক উদ্যোগ নোবেল প্রাইজ পেতে রবীন্দ্রনাথকে সাহায্য করেছে।রথেনস্টাইন ‘গীতাঞ্জলি’ -র পান্ডুলিপির তিনটি কপি পাঠিয়ে দিয়েছিলেন তিনজন দিকপালের কাছে স্টপফোর্ড ব্রুক, ব্র্যাডলী ও ডব্লু.বি.ইয়ে।
১৯১৩-র ১৩ নভেম্বর ১৩ জন সদস্য ভোট দিতে এলেন। একটি বাদে ১২টি ভোট পেলেন রবীন্দ্রনাথ। বিশ্ব জুড়ে ধ্বনিত হল রবীন্দ্রনাথের নাম।১৯১৩-র ১৩নভেম্বর খবরটি ঘােষিত হয়,
“The Noble Prize for Literature for 1913 has been awarded to the Indian Poet Rabindranath Tagore.”
কলকাতায় অধুনালুপ্ত ‘এম্পায়ার’ নামে এক সান্ধ্য দৈনিক সংবাদটি ছেপেছিল ওই ১৩ তারিখেই।ব্রিটিশ উপনিবেশ ভারতবর্ষের একজন কবি বাহান্ন বছর ছয় মাস ছয় দিন বয়সে এই পুরস্কার লাভ করায় সারা পৃথিবীতে হৈ-চৈ পড়ে গিয়েছিল। পুরস্কারের আর্থিক মূল্য ছিল আট হাজার পাউন্ড, তৎকালীন ভারতীয় মুদ্রায় এক লাখ বিশ হাজার টাকা। রবীন্দ্রনাথের নােবেল প্রাপ্তি বিশ্ব সাহিত্যে ঐতিহাসিক ঘটনা হয়ে গেল।