অনলাইন ডেস্ক :
প্রাক সৈনিক জীবনে কাজী নজরুল ইসলাম একজন কিশোরীর প্রেম প্রত্যাশী ছিলেন।সম্ভবত তিনি এই প্রত্যাশী প্রেম পাননি। সামান্য সময়ের জন্য পেয়ে তা হারিয়ে ফেলেছিলেন। এই দুটির কোন একটি কারনে তার প্রেমিকমন বিষিয়ে উঠেছিল।
লেখাপড়া ছেড়ে পল্টনে যোগ দেয়ার পেছনে এটি একটি অন্যতম কারন হতে পারে বলে ধারণা করা হয়। তবে সৈয়দা খাতুন ওরফে নার্গিস আসার খানম, আশালতা সেনগুপ্তা ওরফে প্রমীলা সেনগুপ্তা এবং ফজিলাতুন্নেসা- এই তিন নারী ছিলেন নজরুলের জীবনের প্রতিষ্ঠিত প্রেমিকা।এঁরা প্রত্যেকে নজরুলের জীবনের কবিসত্তায় গুরুত্বপুর্ণ প্রভাব বিস্তার করেছিল।
‘বিদ্রোহী কবি’ কাজী নজরুল ইসলামের প্রধান পরিচয় হলেও তিনি একজন প্রেমিক কবিও বটে। যে বিদ্রোহী কবিতার জন্য নজরুল ‘বিদ্রোহী কবি’ হিসেবে আখ্যায়িত হন সেই কবিতাতেই তিনি বলেছেন – ‘মম এক হাতে বাঁকা বাঁশের বাঁশরি, আর হাতে রণতুর্য’। মূলত, নজরুল সাহিত্যধারায় বিদ্রোহের পাশাপাশি প্রেমের অপূর্ব সম্মিলন ঘটেছে যে তারুণ্যের জোরে তাঁর শির চির উন্নত-চির দুরন্ত দুর্মদ সেই তারুণ্য বন্ধনহারা ষোড়শী কুমরারীর প্রেমেও উদ্দাম, চঞ্চল মেয়ের ভালবাসায় মুখর।
‘বিদ্রোহী’ কবিতাতে কবি আরও বলেন- ‘আমি বন্ধনহারা কুমারীর বেণি, তন্বী নয়নে বহ্নি,/ আমি ষোড়শীর হৃদি-সরসিজ প্রেম উদ্দাম, আমি ধন্যি!/ আমি উন্মন, মন-উদাসীর,/ আমি বিধবার বুকে ক্রন্দন-শ্বাস, হা-হুতাশ আমি হুতাশীর।’মূলত তাঁর সৃষ্টির মধ্য দিয়ে প্রেমের জয়গান গেয়েছেন কবি। মহা বিদ্রোহী রণক্লান্ত কবি প্রেমের শাশ্বত আবেদনের কাছে হার মেনে স্বস্তি খুঁজে পেতে চেয়েছেন- ‘হে মোর রাণী! তোমার কাছে হার মানি আজ শেষে/আমার বিজয় কেতন লুটায় তোমার চরণ-তলে এসে।’
নজরুল জীবনে প্রেমের প্রথম কলিটি হচ্ছে নার্গিস- যার প্রকৃত নাম সৈয়দা খানম (নজরুল তাকে নাম দেন নার্গিস- সৈয়দা নার্গিস আসার খানম, ফার্সি ভাষায় নার্গিস অর্থ গুল্ম, নার্গিস একটি ফুলের নামও বটে)। নার্গিস পুস্তক প্রকাশক আলী আকবর খানের বিধবা বোনের মেয়ে। কলকাতায় ৩২ নং কলেজ স্ট্রিটে আলী আকবরের সাথে পরিচয় ও সখ্যতার সূত্রে নজরুল তার সাথে ১৯২১ সালের মার্চে কুমিল্লা বেড়াতে যাওয়ার সুবাদে নার্গিসের সাথে পরিচয় ও প্রণয় । নজরুলকে নিয়ে আলী আকবর খান তার স্কুলের বন্ধু বীরেন্দ্রকুমার সেনগুপ্তের বাসায় উঠেন। বীরেন্দ্রকুমারের মা ছিলেন বিরজা সুন্দরী দেবী। চারপাঁচ দিন সেখানে কাটানোর পর কবিকে নিয়ে যাওয়া হয় দৌলতপুরের খাঁ বাড়িতে। সেখানে কবির উষ্ণ অভ্যর্থনার ব্যবস্থা করা হয়। বাড়ির জ্যেষ্ঠ আত্মীয়-স্বজনদের সাথে নজরুল খুব দ্রুতই ঘনিষ্ট হয়ে উঠেন।
তাদের কবিতা শুনিয়ে, অজস্র গান গেয়ে মুগ্ধ করে ফেলেন। দূর-দুরান্ত থেকেও লোকেরা আসত কবিকে দেখতে, তার গান শুনতে। আলী আকবর খানের বোন আসমাতুন্নেসার বিয়ে হয়েছিল খাঁ বাড়ির পাশেই। তার স্বামী মুন্শী আবদুল খালেক একটি মেয়ে সৈয়দা খানমকে রেখে মৃত্যুবরণ করেন। এক রাতে কবি খাঁ বাড়ির দীঘির ঘাটে বসে বাঁশি বাজাচ্ছিলেন, সেই বাঁশি সুরে মুগ্ধ হন সেই সুন্দরী যুবতি মেয়েটি। এরপর একদিন নজরুলের এই বাঁশি বাজানো সর্ম্পকে আলোচনার সূত্রে কবির সঙ্গে তিনি আলাপ করেন। এই আলাপ-পরিচয়ের পরই নজরুল মেয়েটির প্রেমে পড়ে যান। আলী আকবর খানও ব্যাপারটা খেয়াল করলেন। মূলত নজরুলকে কুমিল্লা আনবার পিছনেও তার উদ্দেশ্য ছিল নিজ পরিবারের কারো সাথে নজরুলের বিয়ে দিয়ে তাঁকে নিজের নিয়ন্ত্রণে রেখে প্রকাশনা ব্যবসায় উন্নতি করা। নার্গিসের প্রেমে পাগল কবি তাঁকে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নেন এবং এক পর্যায়ে আলী আকবর খানের কাছে বিয়ের প্রস্তাব উত্থাপন করলে তিনি সুযোগটি লুফে নেন।
এরপর নার্গিসের সঙ্গে নজরুলের বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা ও আকদ সম্পন্ন হয়। কিন্তু কাবিননামা সম্পাদনার সময় কবিকে ঘর জামাই হয়ে থাকতে হবে- কৌশুলী আলী আকবরের জুড়ে দেয়া এমন একটি শর্তে ক্ষেপে গিয়ে কবি বিয়ের রাতেই নার্গিস কে ছেড়ে চলে যান । নার্গিসকে ছেড়ে চলে আসার পর আলী আকবর খান কবিকে ফেরানোর জন্য আর্থিক প্রলোভন দেখানোসহ নানাভাবে চেষ্টা করেন। এতে নজরুল আরও ক্ষিপ্ত হন। এরপর দীর্ঘ ১৬ বছর নজরুলের সাথে নার্গিসের আর কোন যোগাযোগ হয় নি। ১৯৩৭ সালে নজরুলকে নার্গিস একটা চিঠি লেখেন। চিঠি প্রাপ্তির সময় সেখানে কবি বন্ধু শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায় উপস্থিত ছিলেন। নজরুল তাকেই চিঠি পড়তে বলেন। চিঠি পড়া শেষে শৈলজানন্দ নজরুলকে উত্তর লিখতে বলেন।
নজরুলের গান ছিল-
‘যারে হাত দিয়ে মালা দিতে পার নাই/কেন মনে রাখ তারে/ভুলে যাও তারে ভুলে যাও একেবারে।/আমি গান গাহি আপনার দুখে,/তুমি কেন আসি দাড়াও সুমুখে,/আলেয়ার মত ডাকিও না আর/নিশীথ অন্ধকারেৃ.।’
১৯৩৭ সালের ১ জুলাই নজরুল নার্গিসকে আর একটি চিঠি লেখেন। এর প্রায় বছর খানেক আগেই শিয়ালদহতে নার্গিস ও নজরুলের উপস্থিতিতে উভয়ের আনুষ্ঠানিক বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটে। কিন্তু প্রথম প্রণয়ী নার্গিস কবির অন্তরে দারুণভাবে রেখাপাত করেছিল। তাকে ত্যাগ করার পরে কবি মনে অপরাধবোধ ও বিষাদ ছিল। নার্গিসকে উদ্দেশ্য করে কবি চক্রবাক কাব্যে বেশ কয়েকটি বিরহের কবিতা লিখেছিলেন। নার্গিসকে উদ্দেশ্য করে কবি লিখেছিলেন, ‘হার-মানা-হার’।
দুলি বা দোলনচাঁপাকে প্রমীলা নামটিও দিয়েছিলেন তিনি। ১৯২১ সালে ছেড়ে এসেছিলেন নার্গিসকে, ১৯২৪ সালে বিয়ে করলেন প্রমীলাকে। অবশ্য বিয়ে করলেন কথাটি যত সহজে উচ্চারিত হলো, তত সহজে সবকিছু সমাধা হয়ে যায়নি। ভিন্ন দুটি সম্প্রদায়ের মধ্যে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপনের ক্ষেত্রে যত রকম চড়াই-উতরাই পেরোতে হয়, সব পেরিয়েই নজরুলের সংসারে এসেছিলেন প্রমীলা। ওদিকে নজরুল যে আর কখনো তাঁর কাছে ফিরবেন না, এই সোজাসাপ্টা হিসাবটা বুঝে নিতে নির্বোধ মেয়েটির সময় লেগেছিল ১৭ বছর।
নজরুল প্রমীলার বিয়ের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয় যেখানে পূর্ণ সমর্থন ছিল কনে পক্ষের একমাত্র অভিভাবক একমাত্র মা গিরিবালা দেবি। তারপরও এই বিয়ে নিষ্কণ্টক ছিল না। সমাজ ছিল এক্ষেত্রে বড় বাঁধা। রক্ষণশীল সনাতন হিন্দু সমাজ কোন মতেই এই বিয়ে মানতে রাজী ছিল না। এছাড়া বিয়েতে ধর্মীয় বাঁধাও ছিল। ১৯২৪ সালের ২৪ এপ্রিল এই বিয়ে সম্পন্ন হয় অনেক ঝামেলার পর। নার্গিসের মত প্রমীলা নজরুলের সাথে প্রতারণা করেননি। বরং সব বাঁধা বিপত্তি পেরিয়ে নজরুলের দারিদ্র্য লাঞ্ছিত পুর্ণ জীবনের দায় একাই বহন করে সবসময় অনুপ্ররণা দিয়ে গিয়েছিলেন কবি হওয়ার জন্য।
জীবনের কোন এক পর্যায়ে কোন এক উচ্চশিক্ষিত নারীর প্রতি দূর্বল হয়ে পড়েছিলেন নজরুল। সৈয়দ আলি আশরাফ সম্পাদিত “নজরুলের প্রেমের এক অধ্যায়” প্রকাশিত হবার পর ফজিলাতুন্নেসার কথা জানা যায়। এত বড় উচ্চশিক্ষিত নারীর কাছে নজরুলের প্রেম নিবেদন ছিল অযৌক্তিক যার ফলস্বরূপ নজরুলকে প্রত্যাখান করেছিলেন ফজিলাতুন্নেসা। প্রেম প্রত্যাখ্যানের পরও নজরুল ছিলেন নাছোড়বান্দা,আশা ছাড়লেন না।
১৯২৮ সালে মুসলিম সাহিত্য সমাজের দ্বিতীয় বার্ষিক সম্মেলনে অতিথি হিসেবে ঢাকা এসেছিলেন নজরুল। এই সংগঠনের সম্পাদক কাজী মোতাহার হোসেনের বর্ধমান হাউসের বাড়িতে আতিথ্য গ্রহণ করেছিলেন তিনি। এ সময়ে ফজিলাতুন্নেসার সঙ্গে পরিচয় হয় তাঁর। নজরুল হস্তরেখা দেখে ভাগ্য গণনা করতে পারেন শুনে নিজের ‘ভাগ্য ও ভবিষ্যৎ’ জানতে আগ্রহী হয়েছিলেন ফজিলাতুন্নেসা। সোৎসাহে বন্ধু মোতাহারকে নিয়ে তাঁর বাসায় গিয়ে উপস্থিত হয়েছিলেন নজরুল।
তবে কাজী মোতাহার হোসেনের স্মৃতিচারণায় এটুকু ইঙ্গিত পাওয়া যায়, এরপর কোনো এক রাতে ফজিলাতুন্নেসার দেওয়ানবাজারের বাড়িতে একা গিয়ে হাজির হয়েছিলেন নজরুল।
এই বিদূষী নারীর কাছে প্রেম নিবেদন করেছিলেন। কিন্তু এতকাল যে তরুণীদের সঙ্গে সান্নিধ্যের সুযোগ তাঁর হয়েছিল, ফজিলাতুন্নেসা ছিলেন তার ব্যতিক্রম। অন্য ধাতুতে গড়া এই নারী তাৎক্ষণিক প্রত্যাখ্যান করেছিলেন তাঁকে। প্রত্যাখ্যানের ভাষা ও আচরণ ছিল রীতিমতো কঠোর। এই আঘাত মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করেছিল কবিকে।
কলকাতা ফিরে গিয়ে সম্ভবত অনুতাপ প্রকাশ করে এবং তাঁকে ভুল না বোঝার আকুতি জানিয়ে ফজিলাতুন্নেসাকে চিঠি লিখেছিলেন কবি। এতে কবির প্রতি সমস্ত অভিযোগ ভুলেছিলেন ফজিলাতুন্নেসা—এমন তো নয়ই, উল্টো ব্যঙ্গ-বিদ্রুপে বিদ্ধ করেছিলেন তাঁকে। সেই চিঠিতে তিনি কী লিখেছিলেন, তা হুবহু জানার উপায় নেই; কারণ সেটি উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। কিন্তু মোতাহারকে লেখা নজরুলের চিঠি পড়ে অনুমান করা যায়, সেই চিঠির ভাষা তাঁর জীবনের স্বস্তি কেড়ে নিয়েছিল, ‘আঘাত আর অপমান এ দুটোর প্রভেদ বুঝবার মতো মস্তিষ্ক আমার আছে। আঘাত করবার একটা সীমা আছে, যেটাকে অতিক্রম করলে আঘাত অসুন্দর হয়ে ওঠে, আর তখনই তার নাম হয় অবমাননা।’
এ রকম অপমানিত হয়েও কি ফজিলাতুন্নেসাকে ভুলতে পেরেছিলেন কবি? পারেননি। নিজের ভুলকে নানাভাবে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছেন বন্ধু মোতাহারকে লেখা চিঠিতে মুহূর্তের দেখা, তারি মাঝে তাঁর কত বিরক্তিভাজন হয়েছি, হয়ত বা কত অপরাধও করে ফেলেছি। পাওয়ার বেভুল আনন্দে কী করেছি না করেছি, কী লিখেছি না লিখেছি তা আমার মনে নেই কোনদিন মনে পড়বেও না।’…তাঁর আঘাত বেদনা অশ্রু আমার শ্বাশতলোকের শূন্য ভান্ডার পূর্ণ করে দিয়েছে।’
রানু সোম : ঢাকার টিকাটুলির মেয়ে রানু সোম যিনি পরবর্তিতে কবি বুদ্ধদেব বসুর সাথে বিবাহ বন্ধকে আবদ্ধ হয়ে প্রতিভা বসু নামে পরিচিতি লাভ করেন। নজরুল ঢাকায় এসে কিছুদিন রানু সোমকে গান শেখাতেন। তাদের মাঝে সুন্দর গুরু-শিষ্য সম্পর্ক গড়ে উঠে।কিন্তু ন্দিুক মঞলে তাদের এই সম্পর্ক নিয়ে নানা কাণা-ঘুষা শুরু হয় ।
মুসলমান যুবক কবি প্রতিদিন হিন্দু যুবতীকে গান শেখানোর আড়ালে ঘনিষ্ট হচ্ছেন, এই অপবাদ চাপিয়ে নজরুলকে হেনস্তা করার উদ্দেশ্যে সজনীকান্ত সেন তার ‘শনিবারের চিঠিতে’ একটি প্যারোডি লেখেন যার নাম ছিল, ‘কে বিদেশী বন-উদাসী বাঁশের বাঁশী বাজাও বনে’। সজনীকান্তের এই প্যারোডি প্রকাশের কিছুদিন পর একরাতে রানু সোমের বনগ্রামের বাসায় থেকে ফেরার পথে ৭/৮ জন হিন্দু যুবকের দল নজরুলকে আক্রমন করে। নজরুল তাদের পালটা আক্রমন করেন, পরে পুলিশ এসে আক্রমনকারি যুবকদের তাড়িয়ে দেন। রানু সোম কবিকে দেবতা জ্ঞানে ভক্তি করেছিলেন। শ্রদ্ধা ও আন্তরিকতার সঙ্গে মিশেছেন এবং নিষ্ঠার সঙ্গে কবির তুলে দেওয়া গান শিখেছেন। কবির প্রত্যাশা ছিল রানু নজরুল গীতির বড় মাপের গুণী শিল্পী হবে। এজন্য উভয়ের সম্পর্ক গুরু-শিষ্যের পর্যায়ে উপনীত হয়েছিল। প্রেমের কোন সম্পর্ক এখানে গড়ে উঠেনি বলে সংশ্লিষ্ট অভিজ্ঞমহল মনে করেন।
উমা মৈত্র : ঢাকা কলেজের তৎকালীন প্রিন্সিপাল সুরেন্দ্রনাথ মৈত্রের মেয়ে উমা মৈত্র (ডাক নাম নোটন)। কবি তাকেও গান শেখাতেন। গান শিখাতে গিয়ে নজরুল কি নোটনের প্রতি দূর্বল হয়ে পড়েছিলেন কিনা তার উত্তর পাওয়া কঠিন। তবে কবি জীবনে নার্গিস-প্রমীলা-ফজিলতুন্নেসার সাথে সাথে উমা মৈত্রের নামও উচ্চারিত হয়েছে। ধারণা করা হয় উমা মৈত্রের স্মৃতি কবি তার ‘শিউলিমালা’ গল্পটিতে ধরে রেখেছেন। গল্পটির কিছু অংশ এরূপ- “শিউলি আমার কাছে গান শিখতে লাগল। কিছুদিন পরেই আমার তান ও গানের পুঁজি প্রায় শেষ হ্যে গেল।
মনে হল আমার গান শেখা সার্থক হয়ে গেল। আমার কন্ঠের সকল সঞ্চয় রিক্ত করে তার কন্ঠে ঢেলে দিলাম। আমাদের মালা-বিনিময় হল না-হবেও না এ জীবনে কোন দিন- কিন্তু কন্ঠ বদল হয়ে গেল। আর মনের কথা সে শুধু মনই জানে।ৃ একমাস ওদের বাড়িতে ছিলাম। কত স্নেহ, কত যত্ম, কত আদর। অবাধ মেলা মেশা- সেখানে কোন নিষেধ, কোনো গ্লানি, কোন বাধা বিঘ্ন, কোন সন্দেহ ছিল না। আর এসব ছিল না বলেই বুঝি এতদিন ধরে এত কাছে থেকেও কারুর করে কর স্পর্শ-টুকুও লাগে নি কোনদিন। এই মুক্তিই ছিল আমাদের সবচেয়ে দুর্লঙ্ঘ্য বাধা। কেউ কারো মন যাচাই করিনি। কোন প্রশ্ন জিজ্ঞাসার কথাও উদয় হয় নি মনে। একজন অসীম আকাশ, একজন অতল সাগর। কোন কথা নেই-প্রশ্ন নেই, শুধু এ ওর চোখে, ও এর চোখে চোখ রেখে তাকিয়ে আছে”।
জাহানারা বেগম : জাহানারা বেগম চৌধুরী ওরফে মীরা পশ্চিমবঙ্গের মেয়ে ‘বর্ষবাণী’ নামে একটি বার্ষিক পত্রিকার সম্পাদিকা। তার সাথে নজরুলের প্রথম পরিচয় হয় ১৯৩১ সালে দার্জিলিং ঘুরতে গিয়ে। সেইবার দার্জিলিংএ আরো উপস্থিত ছিলেন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, মৈত্রয়ী দেবী, ঢাকা কলেজের অধ্যক্ষ সুরেন্দ্রনাথ মৈত্র ও তার মেয়ে উমা মৈত্রসহ আরো বিখ্যাত কয়েকজন।
নজরুলের একটি গানের খাতা জাহানারা বেগমের কাছে ছিল যাতে ছিল ৮ টি কবিতা ও ৭ টি গান। নজরুলের জীবনকালে এগুলো অপ্রকাশিত থেকে যায়। জাহানারা বেগম চৌধুরী মৃত্যুর আগে এগুলো প্রকাশের অনুমতি দিয়ে যান। সেখানে কয়েকটি কবিতায় জানাহারাকে নিয়ে রচনা করা কয়েকটি কবিতা পাওয়া যায়। তবে নার্গিস-প্রমীলা বা ফজিলতুন্নেসার মত কবি জাহানারাকেও ভাল বেসেছিলেন কিনা সেই প্রশ্ন আজও প্রশ্নই রয়ে গেছে।
শিল্পী কানন দেবী: শিল্পী কানন দেবীকেও কবি নজরুল গান শিখিয়েছিলেন। তার সঙ্গে নজরুলের সম্পর্ক নিয়েও নিন্দকেরা নানা মুখরোচক কাহিনী রটনা করেছিলেন।কানন দেবীকে নিয়ে একটি সংবাদ রটানো হয়েছিল এমন যে, কবিকে কলকাতার কোথাও না পেলে কানন দেবীর বাড়িতে অবশ্যই পাওয়া যাবে। কলকাতার পত্রিকা ‘শনিবারের চিঠির’ সম্পাদক সজনীকান্ত কানন দেবীকে নিয়েও রসালো কাহিনী প্রচারে পিছিয়ে রয়নি। অথচ, বাস্তব হয়ত ভিন্ন ছিল বলে মনে করা হয়।
ব্যথার দান গ্রন্থের উৎসর্গপত্রে কবি লিখেছেন-‘মানসী আমার, মাথার কাঁটা নিয়েছিলুম বলে ক্ষমা করোনি, তাই বুকের কাঁটা দিয়ে প্রায়ম্চিত্য করলুম।” কবির এই মানসীর পরিচয় আজও রহস্যাবৃত।
সত্য-সুন্দর-সৌন্দর্যের পূজারি নজরুল আজীবন বড় প্রেমের কাঙাল ছিলেন। প্রেম নাকি কবিমানসের প্রধান প্রেরণা । প্রেমিক কবি নজরুলের মন তো প্রেমময় হবেই । আর তাই প্রেম তার জীবনে এসেছিল বারবার-কখনো ঝড়ের মতো, কখনো নিভৃতে । ব্যক্তিগত জীবনে আরাদ্ধ নারীকে ভালবাসার পাশাপাশি নজরুল দেশকে ভালবেসেছিলেন, মানুষকে ভালবেসেছিলেন, মানবতাকে ভালবেসেছিলেন, ভালবেসেছিলেন সত্য-সুন্দরকে। কিন্তু ব্যক্তি জীবনে প্রেমে ব্যর্থতার পাশাপাশি রাজনৈতিক ও সমাজ বাস্তবতার বৈপরিত্বে সত্য-সুন্দর-সৌন্দর্যের স্বপ্নপুরীতে যখন কুৎসিৎ কীটের দংশন প্রত্যক্ষ করেছেন তখন কবি দারুণভাবে আহত হয়েছেন। তাঁর হৃদয়ে যে রক্ত ক্ষরণ হয়েছে তার নিঃসরণ ঘটিয়েছেন তাঁর লেখনির মাধ্যমে, সুরের বেহাগে, সভা-সমিতির বক্তৃতায়-ভাষণে। তার কাব্যে, গানে, গল্পে, উপন্যাসে বারবার তাই উপজীব্য হয়েছে প্রেম। মানুষের মানবিক অনুভূতির অনন্য ভাষা ভালোবাসা ও প্রেমকে তিনি সাহিত্য অঙ্গনে নিয়ে গেছেন অনন্য উচ্চতায়।
বাক্ ও বোধ শক্তি হারাবার আগে ১৯৪১ খ্রিস্টাব্দের এপ্রিল মাসে নজরুল ‘বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতির’ বিশেষ অধিবেশনে সভাপতির ভাষণে বলেছিলেন- ‘আমি প্রেম দিতে এসেছিলাম, প্রেম পেতে এসেছিলাম, সে প্রেম পেলাম না বলে আমি এই প্রেমহীন নিরস পৃথিবী থেকে নীরব অভিমানে চিরদিনের জন্য বিদায় নিলাম।’ বস্তুত এমন অভিমান নিয়েই নজরুল দীর্ঘ ৩৪ বছর নীরবে কাটিয়ে ৭৭ বছর বয়সে পৃথিবী থেকে চিরদিনের জন্য বিদায় নিয়েছেন। তবে প্রেমের কাঙাল এই কবি ব্যক্তিগত শত ব্যথা-বঞ্চনা ও দুঃখ-দারিদ্রের মাঝেও এক অপরিমেয় শক্তিবলে জীবনের ভান্ড শুন্য রেখে সৃষ্টির ভান্ডারকে পরিপূর্ণ করে তুলেছিলেন। যার মধ্যদিয়ে সমৃদ্ধ হয়েছে বাংলা সাহিত্য ও সঙ্গীত ধারা।