লক্ষ্মীপুরে বছরে প্রায় দুইশত কোটি টাকা বিনিয়োগ হয় ট্রলার তৈরিতে

লক্ষ্মীপুরে বছরে প্রায় দুইশত কোটি টাকা বিনিয়োগ হয় ট্রলার তৈরিতে

জেলা

মুসফিকুর রহমান সৈকত, লক্ষ্মীপুর প্রতিনিধি:
লক্ষ্মীপুরে তৈরি হচ্ছে সব ধরনের ছোট-বড় নৌকা ও সমুদ্রে চলাচলকারী ফিশিং ট্রলার। এ পেশায় নিয়োজিত কারিগরদের কোন ধরনের প্রশিক্ষণ না থাকলেও শুধুমাত্র অভিজ্ঞতা দিয়েই বছরে প্রায় চারশত ট্রলার তৈরি করছেন তারা। এতে করে এ অঞ্চলের বিপুল সংখ্যক জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে। লক্ষ্মীপুরে ট্রলার ও নৌকা তৈরির কয়েকজন কারিগর, শ্রমিক ও সংশ্লিষ্টরা জানান, বছরে এ খাতে বিনিয়োগ হচ্ছে প্রায় দুইশত কোটি টাকা।

জানা যায়, সমুদ্রে মাছ ধরার ফিশিং ট্রলারগুলো বিদেশ থেকে আমদানি করা হলেও বর্তমানে লক্ষ্মীপুরেই তৈরি হচ্ছে এ যানটি। এতে করে অর্থ সাশ্রয়ের পাশাপাশি এ অঞ্চলের সহস্রাধিক মানুষের কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হচ্ছে। এ অঞ্চলে সম্ভাবনাময় এ শিল্পটি বিকশিত হলে আরো কয়েক হাজার মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে।
এদিকে লক্ষ্মীপুরের রামগতি উপজেলার টাংকি বাজার, চরগাজী, আসলপাড়া, আলেকজান্ডার মাছঘাট, কমলনগর উপজেলার মতিরহাট, ভাঙ্গাপুল, জারিরদোনা, লুধুয়া, ফলকন, পাটোয়ারিরহাট, সদর উপজেলার মজুচৌধুরীরহাট, বেঁড়ির মাথা ও রায়পুর উপজেলার চরবংশী, হাজীমারাসহ জেলার প্রায় ১৩টি স্থানে ছোট-বড় নৌকা ও সমুদ্রে চলাচলকারী ফিশিং ট্রলার তৈরি করেন কারিগররা।

রামগতি উপজেলার চররমিজ এলাকার হোসেন মিস্ত্রির সাথে কথা হয়। তিনি জানান, কার্তিক মাসের মাঝামাঝি থেকে শুরু করে জ্যৈষ্ঠ মাসের মাঝামাঝি পর্যন্ত ট্রলার ও নৌকা তৈরির মৌসুম। শুকনো মৌসুম ছাড়া নৌকা তৈরি করা যায় না। আবার বর্ষা মৌসুম হচ্ছে মাছ ধরার মৌসুম। তখন নৌকা তৈরি বা মেরামত করা হয় না।
ফিশিং ট্রলার তৈরির কয়েকজন কারিগর জানায়, সমুদ্রে চলাচলকারী একটি ফিশিং ট্রলার তৈরিতে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত বিভিন্ন কাজের কমপক্ষে দশজন কারিগর লাগে। আর তাদের সাথে ৬০০ থেকে ৭০০ শ্রমিক কাজ করে। একজন কারিগরের সাথে ৪-৫ জন শ্রমিক প্রতিদিন কাজ করেন। কারিগররা চুক্তিভিত্তিক কাজ নেন। পরে দৈনিক হাজিরা ভিত্তিতে শ্রমিকদের সাথে নিয়ে তারা ট্রলার তৈরি করেন।

স্থানীয় কারিগররা জানায়, নৌকা ও ট্রলার বানানোর কাজ প্রথমে শুরু করেন কাঠ মিস্ত্রি। কাঠ মিস্ত্রি গলুই, চান্দিনা, ছই, রান্নাঘর, ওয়াশরুম তৈরি করেন। কাঠের জোড়ার ফাঁকে সুতার সলতে ঢুকানো বা ‘গাইনির কাজ’ করেন আরেক দল। গাইনির কাজের পর কেরোসিন তেলের সঙ্গে ধূপ ও পানি মিশিয়ে শুরু হয় পুটিংয়ের কাজ। পরে ট্রলারের নিচের অংশে আলকাতরা লাগাতে হয়। এরপর ইঞ্জিনের সঙ্গে লাগানো হয় পেছনের পাখা। সবশেষে করা হয় রঙের কাজ।
ট্রলার মিস্ত্রী আবুল খায়েরের সাথে কথা হয় আলেকজান্ডারের আসলপাড়ায়। তিনি জানান, আগে ফিশিং ট্রলার থাইল্যান্ড ও মায়ানমার থেকে কিনতে হতো। কিন্তু এখন স্থানীয়ভাবেই তা তৈরি হচ্ছে। সমুদ্রে চলাচলকারী একেকটি ট্রলার তৈরিতে সময় লাগে প্রায় ৫ মাস। একটি ট্রলার তৈরিতে কাঠের প্রয়োজন পড়ে কমপক্ষে ১২শ ঘনফুট এবং খরচ হয় ৭-৮ লক্ষ টাকা। আর প্রতিটি ট্রলারে ইঞ্জিন ও জালসহ খরচ পড়ে ৮০ লাখ থেকে প্রায় কোটি টাকা। সমুদ্রে চলাচলকারী ফিশিং ট্রলারগুলো ৫৬ ফুটের বেশি লম্বা এবং প্রায় সাড়ে ১৬ ফুট প্রস্থের হয়। এসকল ট্রলার তৈরিতে আমদানি করা বিদেশী লোহা কাঠ, ওক এবং চাপালিশ কাঠ ব্যবহৃত হয়।

একই এলাকার জসিম মাঝি নামের মিস্ত্রী জানান, ছোট নৌকা তৈরিতে দেশীয় মেহগনি, চাপালিশ, রেইনট্রি কড়ই, নলকড়ই, পুনাল, নাড়াই, গর্জন, চাম্বল, ত্রিশূল শিশুগাছ ব্যবহৃত হয়। ছোট কিংবা মাঝারি নৌকা তৈরিতে সময় লাগে ১ থেকে ২ মাস। এতে প্রায় তিনশত শ্রমিক লাগে। আর জাল এবং ইঞ্চিনসহ খরচ পড়ে ২০-২৫ লাখ টাকা।
ট্রলার মিস্ত্রী ও নৌকার কারিগরদের সাথে কথা বলে জানা যায়, বছরে তিন শতাধিক মাছ ধরার নৌকা ও সমুদ্রে চলাচলকারী শতাধিক ফিশিং ট্রলার লক্ষ্মীপুরের বিভিন্নস্থানে তৈরি হয়।

মতিরহাট মাছ ঘাটের মাছ ধরার নৌকার মালিক এমরান জানান, দেশীয় কাঠের তৈরি ট্রলার ৮-১০ বছর টিকে। আর আমদানিকৃত কাঠের তৈরি ট্রলার প্রায় ১৫-২০ বছর অনায়াসে ব্যবহার করা যায়।
ট্রলার তৈরির কারিগর বেলায়েত মাঝি জানান, ৩০ বছর ধরে এ পেশায় কাজ করছেন তিনি। আগে ভোলায় কাজ করলেও এখন লক্ষ্মীপুরের রামগতিতে ট্রলারের কারিগর হিসেবে প্রতিদিন ১ হাজার থেকে ১২শ’ টাকা মজুরি পেয়ে থাকেন।

ট্রলার শ্রমিক ও জেলেরা জানালেন, সমুদ্রের ট্রলারগুলো দ্রুত গতিসম্পন্ন হয়। উত্তাল সমুদ্রের মাঝে ঘণ্টায় ২০ থেকে ২২ কিলোমিটার এবং অনুকূলে ঘণ্টায় ৩৫ থেকে ৪০ কিলোমিটার বেগে চলতে পারে এটি। চায়নাসহ বিদেশী আমদানি করা কোম্পানীর নতুন ও রিকন্ডিশন ১৪০ থেকে ২৯০ হর্স পাওয়ারের শক্তিশালী ইঞ্জিন ট্রলার ও নৌকাতে বসানো হয় বলে জানালেন তারা।

লক্ষ্মীপুরের জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো: আমিনুল ইসলাম জানালেন, জেলায় অনুমোদিত সরকারি বা বেসরকারি কোন ডকইর্য়াড নেই। লক্ষ্মীপুরে স্থানীয়দের উদ্যোগেই ট্রলারগুলো তৈরি হচ্ছে। লক্ষ্মীপুরের মেঘনা নদীতে প্রায় ৩ হাজার অনুমোদিত ফিশিং ট্রলার রয়েছে বলেও জানান এই কর্মকর্তা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *