ইমরুল সুমন:
কয়েক মাস ধরেই তালের উৎসব চলছে বাংলাদেশে। বেশ কিছুদিন তালের বিচির শ্বাস খেয়েছে সবাই। প্রতি পিস বিচি ১০ টাকা করে দাম। একটি তালে সাধারণত ৩টি বিচি থাকে। কোনটিতে ২টি বা ১টি বিচিও থাকতে পারে। এখন শ্রাবণের বর্ষা মওসুম চলছে। পাকা তালে সয়লাব বাজার। শুরুতে বড় পাকা তাল ২০০ টাকা দরে বিক্রি হয়েছে প্রতিটি। এখন ৫০ টাকায় বড় একটি পাকা তাল পাওয়া যাচ্ছে। বাজারে গেলেই পাকা তাল চোখে পড়ে। এর রস সুস্বাদু আর পুষ্টিকর, ভেজালহীন।
এবার আসুন তালগাছের ব্যবহার নিয়ে কিছু কথা বলি। তালগাছ বাবুই, টিয়া, শালিক, চড়ুই, বুলবুলি, ফিঙে, দোয়েলসহ অনেক পাখির আশ্রয়স্থল। বাবুই পাখি তালের পাতা দিয়ে তালগাছেই বাসা বানাতে পছন্দ করে বেশী। এর বাইরে নলখাগড়ার পাতা দিয়েও বাবুই তালগাছে বাসা বানায়। তালগাছের রস দিয়ে নেশা করেন অনেকেই। এরকম কাহিনী আছে গল্প কাহিনী সিনেমা চলচ্চিত্রেও। এই যেমন নিচের গানটি তালের রস নিয়ে লেখা ও গাওয়া-
“তালের রসের রসিক আমি
হইনা বেহুস বেতাল,
বোতল বোতল গেলে যারা
তারাই হয় মাতাল।
আমি ভাই নেশা করি না
আমি ভাই মিথ্যে বলি না।”
সিলেটের চা বাগানকে প্লট হিসাবে বেছে নেয়া গল্পের ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা বাংলাদেশের নায়িকা শাবানা ও পাকিস্তানের নায়ক নাদিম অভিনীত যৌথ প্রযোজনার “শক্তি” সিনেমায় তালের রস নিয়ে এ গানটিতে অভিনয় করেছিলেন পাকিস্তানের কৌতুক অভিনেতা রঙ্গিলা।
আসুন, কম করে হলেও একটা পাকা তাল কিনি। এর চেয়েও জরুরি এর বীজটা কোথাও লাগিয়ে দেই। তাল গাছের কাচা শ্বাস খেতে সুস্বাদু। পাকা তালের রসও বেশ মজার। তালের পিঠা সবার প্রিয় একটি খাদ্য। তালের পাখা তো গরমের আরাম। আর তালের রস খেয়ে পৃথিবী রঙিন দেখাটা তো সৌভাগ্যের ব্যাপার!
তালগাছ বজ্র, বাজ বা ঠাডা থেকে আমাদের রক্ষা করে। অনেকেরই প্রশ্ন- তাল গাছ বজ্রপাত থেকে কিভাবে পশু পাখিকে রক্ষা করে। বজ্র সচরাচর জীবিত বস্তুর ওপর পরে। সেটা জীবজন্তু, পশুপাখি, গাছপালা হতে পারে। তালগাছ জীবিত একটি বৃক্ষ। আপনারা হয়তো সবাই জানেন গাছেরও জীবন আছে। সেটা প্রমান করেছেন বিক্রমপুরের বাঙালী বিজ্ঞানী স্যার জগদীশ চন্দ্র বসু। বজ্র উর্ধ্ব আকাশ থেকে পড়ায় উপরে যাকে পায় তাকে সবার আগে স্পর্শ করে। তালগাছ সব এলাকায় সবচেয়ে উঁচু গাছ হিসাবে পরিচিত। কোন এলাকায় কখনো বজ্রপাত হলে উঁচু বস্তু বা বাড়ির ওপর পরে। তালগাছ উঁচু হওয়ায় তার ওপরে সবার আগে বজ্র পরে। তালগাছ নিজের জীবন দিয়ে বজ্রকে গ্রহন করে সেটিকে অন্য বস্তুতে আঘাত হানা থেকে বিরত রাখে। এ ক্ষেত্রে হয়তো তালগাছটি বজ্রপাতের কারণে মারা যায়। বেঁচে যায় আশেপাশের মানুষ, জীবজন্তু, পশুপাখি ও গাছপালা। সকল বাড়ি বা বিল্ডিংয়েই নিরাপত্তার জন্য বজ্রনিরোধক দন্ড বসানোর নিয়ম আছে। কিন্তু পাইলিং বা আর্থিং করে বজ্রনিরোধক দন্ড বসাতে খরচ বেশী হওয়ায় আমরা অনেকেই সেটা করি না। জীবনের নিরাপত্তার বিষয়টি ভুলে যাই। কোন দুর্ঘটনা ঘটলে সেটা নিয়ে হৈ চৈ থাকে কিছুদিন। আমাদের দেশে তালগাছ কম খরচে বজ্রপাত নিরোধে একটা কার্য্যকর ব্যবস্থা হতে পারে।
আজকাল বজ্রপাত খুব বেশী পরিমানে হচ্ছে। কেন হচ্ছে সেটার অনেক ব্যাখ্যা থাকতে পারে। তবে বজ্রপাত থেকে রক্ষা পেতে কি করতে হবে সেটা আমাদের সবার জানা উচিত। বজ্রপাত শুরু হলে খোলা মাঠে থাকা যাবে না একদম। দ্রুত কোন বাড়ি ঘরের আশ্রয়ে বা নিচে চলে আসতে হবে। ভালো হয় কোন বিল্ডিং বা দালানের নিচে আশ্রয় নিতে পারলে।নইলে অন্য যে কোন ঘরের নিচে আশ্রয় নিতে হবে। গাড়ির মধ্যে থাকলে সেটাও কোন বিল্ডিং এর নিচে আনতে পারলে ভালো। অনেকেরই ভুল ধারণা আছে বজ্রপাত শুরু হলে গাছের নিচে আশ্রয় নিবেন। সেটা একদম করা যাবে না। মনে রাখবেন গাছও জীবিত একটি বস্তু। আর বজ্রপাত জীবিত বস্তুর দিকেই ছুটে আসে। বজ্রপাতের সময় কয়েকজন ব্যক্তি খোলা মাঠে বা ফসলী জমিতে থাকলে এবং নিরাপদ আশ্রয়ে যাওয়া সম্ভব না হলে প্রত্যেকেই আলাদা হয়ে যেতে হবে। যতটা সম্ভব একজন থেকে আরেকজন আলাদা বা দূরে সরে যাবেন। আর বজ্রপাতের সময় খোলা মাঠে দাঁড়িয়ে না থেকে বসে থাকতে হবে মাটির কাছাকাছি। সম্ভব হলে পুরো পায়ের ওপর ভর না দিয়ে আঙুলের ওপর ভর দিয়ে বসে থাকতে হবে নিচু হয়ে। তবে মাটিতে শুয়ে থাকা যাবে না। দেহটাকে যতটা সম্ভব ছোট ও খাটো করে মাটির কাছাকাছি নিচু হয়ে থাকতে হবে।
মোবাইলের যথেচ্ছ ব্যবহার, সীমানা পিলার চুরি, বৈদ্যুতিক খুটি সরানো, বাড়ি ঘরে বজ্রনিরোধক দন্ড না বসানো ইত্যাদী বিভিন্ন কারনে দেশে বজ্রপাতের হার বেড়ে গেছে। আগে বৈদ্যুতিক খুটিতে টাঙানো ওপরের বড় মোটা তারটি বজ্রনিরোধক হিসাবে কাজ করতো। এখন সেটা করে কি না বা সেরকম তার ব্যবহার হয় কি না সেটা আমার জানা নেই। বৈদ্যুতিক তারের বড় বড় ক্যাবল এখন মাটির নিচ দিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। একটা সীমানা পিলার বজ্রপাত নিরোধ করতো। এখন সেই সিমানা পিলারগুলো ‘পাওয়ার’ বা ক্ষমতার হাতিয়ার হিসাবে পরিচিত হওয়ায় অনেকেই সেগুলো চুরি করে বিক্রি করে দিচ্ছেন। বজ্রপাত থেকে মানুষ, পশুপাখি ও গাছপালাকে রক্ষা করতে ব্রিটিশ সরকার যে উদ্যোগ নিয়েছিল সেটা ভেস্তে গেছে বাঙালীর চুরি বিদ্যার মুন্সিয়ানায়!
এদেশে এখন প্রতিবছর অসংখ্য মানুষ বজ্রপাতে মারা যাচ্ছে। বজ্রপাত থেকে নিজেদের রক্ষা করতে তাল গাছ লাগানোটা জরুরী হয়ে পড়েছে। আমাদের দেশে সব এলাকায় তাল গাছ নেই। অনেকেরই ভুল ধারণা- তাল গাছ লাগিয়ে সেটা যে লাগায় সে ফল খেতে পারে না। সে ফল খেতে পারে হয়তো তার নাতি পুতি। একথা সঠিক নয় বলে জানান, তালের চারা উৎপাদনকারী নওগাঁর মন্ডল নার্সারির মোহাম্মদ বেলাল। তিনি বলেন, ‘তাল গাছ বড় হতে ৭ থেকে ৮ বছর লাগে।’ তিনি তালের বিচি বিক্রি করেন প্রতিটি ৩ টাকা থেকে ৫ টাকা করে। আর তালের চারা বিক্রি করেন প্রতিটি ৬০ টাকা দরে। কুরিয়ারে সেটা আনলে চারা প্রতি আরো ৩৫ টাকা বেশি লাগবে। মানে ২ ফুট উঁচু এক বছরের একটা চারার দাম পড়বে ৯৫ টাকা। সংখ্যা বেশী হলে দাম কমতেও পারে।
আসুন, শ্রাবণে একটা তালের বীজ লাগিয়ে প্রাণ জুড়াই।
বজ্রপাত হতে নতুন প্রজন্মকে, নিজেদের রক্ষা করি।